Hot!

অর্পিত সম্পত্তি: আরেকবার ফিরে দেখা


-ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল


বংলাদেশের সবাই মোটামুটি এক বাক্যে বলবেন যে, ‘বাংলাদেশ সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত; সব ধর্মের লোক যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে এ দেশে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে, ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সমঅধিকার- ’৭২ সাল থেকেই সংবিধানে স্বীকৃত।’ কিন্তু বাস্তবে এই কথাটা কতখানি সত্যি? শুধু অর্পিত সম্পত্তি আইনের নিষ্পেষণেই গত ৪৫ বছরে এই দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সমপ্রদায়ভুক্ত লাখ লাখ পরিবার অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অগণিত পরিবার বসতভিটা হারিয়ে, সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব হয়েছেন। এই আইনটির পেছনে আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষেপে বলতে গেলে- এই আইনটি ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক টানাপড়েনের ফসল। ‘দ্য ডিফেন্স অব পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ১৯৬৫’-এর মাধ্যমে আইনটি করা হয়, যা শত্রু সম্পত্তি আইন নামে পরিচিত। ওই অধ্যাদেশের ১৬৯ উপবিধি অনুযায়ী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যেসব নাগরিক ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের আগে থেকে ভারতে ছিল এবং সেই তারিখ থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই সঙ্গে তাদের বাড়িঘর ও জমিজমা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবে, যার মালিকানা সরকার অস্থায়ীভাবে নিয়ে নিতে পারে।

আশ্চর্যজনকভাবে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭৬ সালের দি এনিমি প্রপার্টি (কন্টিন্যুয়ান্স অফ ইমারজেন্সি প্রভিসন) (রিপিল) (এমেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স এবং দি ভেস্টেড অ্যান্ড নন-রেসিডেন্ট প্রপার্টি (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৪, এ আইন দুটির মাধ্যমে ‘শত্রু’ সম্পত্তির ধারণা টিকে গিয়েছিল এবং নতুন করে কোনো সম্পত্তির অধিগ্রহণ বন্ধ হলেও সরকার সম্পত্তিগুলো সত্যিকারের মালিকদের কাছে বা তাদের শরিকদের মাঝে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য ছিল না। বলা যায়, এই দুটি আইনের কারণে আজো এই একবিংশ শতাব্দীতে লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক শত্রু বা এনিমি হিসেবে পরিচিত হচ্ছে এবং তাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় আইনটি অর্পিত সম্পত্তি আইন নামে পরিচিত। আরো আশ্চর্যের বিষয়- যারা হিন্দু নাগরিক হিসেবে ভারতে অবস্থান করছেন, শুধু তাদের ক্ষেত্রেই এই বৈষম্য করা হচ্ছে (খুশি কবীর, ভূমিবার্তা, জুলাই ২০১২)। বাংলাদেশের বাইরে, এমনকি ভারতে কিংবা পাকিস্তানে অবস্থানরত যে কোনো বাংলাদেশি মুসলিম নাগরিকের সম্পত্তি কিন্তু শত্রু বা অর্পিত সম্পত্তি নয় এবং তাদের জমি হারাবার ভয়ও নেই (বারকাত, জামান, রাহমান এবং পোদ্দার, ১৯৯৭)। সন্দেহাতীতভাবে উল্লিখিত ‘বৈষম্য সৃষ্টিকারী’ আইন দুটি শুধু সংবিধানবিরোধীই নয়, বাংলাদেশ কর্তৃক স্বাক্ষরিত যে কোনো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থীও বটে। আইন দুটি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সাংবিধানিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। যেমন: সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে। একইভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ১১ (গণতন্ত্র ও মানবাধিকার), তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকার অংশের অনুচ্ছেদ ২৭ (আইনের দৃষ্টি সমতা) এবং অনুচ্ছেদ ২৮(১) (ধর্ম প্রভৃতির কারণে বৈষম্য)। দু’ভাবে এই অনুচ্ছেদগুলো লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রথমত, শুধু ধর্মের কারণে বাংলাদেশের কিছু নাগরিককে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং দ্বিতীয়ত, আইন দুটি বাংলাদেশে শান্তি ও সমপ্রীতির মধ্য দিয়ে ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করছে। এই ধরনের অসাংবিধানিক আইনের কারণে হিন্দু সমপ্রদায়ের নাগরিকরা ভোগ করতে পারছেন না তাদের ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৩ (গ)) এবং সেই সাথে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের উত্তরাধিকার আইনের প্রয়োগ ও বিক্রয়সহ অন্যান্যভাবে সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকারও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আইন দুটি সংবিধানের ১৪৩ ও ১৪৪ অনুচ্ছেদের সাথেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সরকার অর্পিত হিসেবে শুধু সেই সম্পত্তিকেই ঘোষণা করতে পারবে যার কোনো মালিক নেই। অথচ বেশিরভাগ অর্পিত বা শত্রু সম্পত্তির ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, তাদের মালিক বা উত্তরাধিকারীরা বা যৌথ সম্পত্তির অংশীদার হিসেবে দাবিদার বাংলাদেশের ভেতরেই অর্পিত সম্পত্তির পাশের জমিতেই অবস্থান করছেন। এই অসাংবিধানিক আইন দুটির কারণে প্রায় ৩৫ লাখ ৯০ হাজার হিন্দু নাগরিক তাদের সম্পত্তি হারিয়েছেন, হয়েছেন বাস্তুহারা, দেশছাড়া, পরিচয়বিহীন। অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রতি ৩৪টি হিন্দু পরিবারের মধ্যে ১০টি হিন্দু পরিবার অর্পিত সম্পত্তি আইনের কারণে তাদের সহায়-সম্বল হারিয়েছেন। (বারকাত, জামান, রাহমান এবং পোদ্দার, ১৯৯৭)। এ হয়রানি ও দুর্ভোগের অবসান এবং পূর্বপুরুষের সম্পত্তিতে তাদের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, অসামপ্রদায়িক ও গণতন্ত্রপ্রিয় কিছুসংখ্যক মানুষ বিগত চার দশক ধরে নানাভাবে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছেন। জাতীয় সংবাদমাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ক দুর্ভোগ-হয়রানির প্রতিবেদন প্রচার এবং ক্রমবর্ধমান নাগরিক আন্দোলন ও জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১ সংসদে পাস করা হয়। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টও নাগরিক আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে রায় দেন যে, ২৩ মার্চ ১৯৭৪-এর পর থেকে নতুন করে কোনো শত্রু সম্পত্তি মামলা করা যাবে না। কারণ ১৯৬৯ সালের ১নং অর্ডিন্যান্স বাতিল হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শত্রু সম্পত্তি ধারণাটির মৃত্যু হয়েছে। এর মাধ্যমে আদালত একটি তারিখ নির্দিষ্ট করে দিলেন, যার পর কোনো সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত হলেও তাকে আর শত্রু সম্পত্তি বলা যাবে না এবং সরকারের পক্ষে সম্পত্তিগুলো ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো সমস্যা থাকল না (আরতি রাণী পাল বনাম এস কে পাল, ৫৬ ডি এল আর (এ ডি) ২০০৪)। কিন্তু তৎকালীন সরকারের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে তাড়াহুড়োর কারণেই সম্ভবত আইনটিতে কিছুটা অসঙ্গতি বা দুর্বলতা থেকে গিয়েছে, যার কারণে আইনটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিজয়ী চার দলীয় জোট সরকার একটি সংশোধনী এনে আইনটি সম্পূর্ণ অকার্যকর করে দেয়। আবারো চাপা পড়ে যায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু নাগরিকদের অধিকার ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা। ২০০১ সালের প্রত্যর্পণ আইনে যেসব দুর্বলতা ধরা পড়েছিল, সেগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা প্রয়োজন। আইনটির অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল ‘মালিক’ শব্দটির সংজ্ঞা নিয়ে। ওই আদেশের ২নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা তার পিতা বা পিতামহ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করে থাকলে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে ও তারপরেও অব্যাহতভাবে এই ভূখণ্ডে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করে থাকলে অথবা কোনো ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে ও তারপরে অব্যাহতভাবে এই ভূখণ্ডে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করে থাকলে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। এই বিধানগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, শত্রু সম্পত্তি আইন বা অর্পিত সম্পত্তি আইন ব্যবহার করে যাদের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তারা বা তাদের উত্তরাধিকারী বা স্বার্থাধিকারীরা পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলেও এ আইন অনুযায়ী সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার অধিকারী হবেন না। কার্যত এর মানে দাঁড়ায়, শত্রু সম্পত্তি আইনের বিধান অনুসারে যাদের সম্পত্তি সরকারের হাতে অর্পিত হয়েছিল, তারা কোনোমতেই প্রত্যর্পণের দাবিদার হতে পারছেন না। এমনকি কোন সম্পত্তি তারা ফিরে পাবেন, সেটাও নির্দিষ্ট করা ছিল না। আইনের ২(ঞ) ধারায় বলা হয়েছে, কেবল সেসব সম্পত্তি তারা ফিরে পাওয়ার জন্য দাবি করতে পারবেন, যেগুলো নতুন আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে সরকারের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্থাৎ যেসব সম্পত্তি সরকারি তালিকাতে রয়েছে, কিন্তু সরকারের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে নেই, ইতিমধ্যেই বেদখল হয়ে গেছে, সেসব সম্পত্তি এ আইনের অধীনে প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে না। সরকারের কাছে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মোট জমির পরিমাণ সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে যে, অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড হওয়া মোট সম্পত্তির খুব নগণ্য একটি অংশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু এ সম্পত্তির সবটুকুও প্রত্যর্পণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হবে না। কারণ, প্রত্যর্পণ আইনের ৬(চ) ধারায় বলা হয়েছে, জনস্বার্থে অধিগ্রহণ করা হয়েছে, এমন কোনো অর্পিত সম্পত্তিও প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। অথচ জনস্বার্থ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, আইনে তা বলা হয়নি। এ অবস্থায় আশঙ্কা করা অনুচিত ছিল না যে, জনস্বার্থের নামে অনেক প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তিও হয়তো বিশেষ বিশেষ কারণে তালিকা থেকে বাদ পড়বে এবং ভবিষ্যতে কখনো কেউ এসব বেদখল হওয়া জমি বা জনস্বার্থে গৃহীত জমি ফিরে পাওয়ার দাবি করতে পারবে না। সুতরাং আইনের এ ফাঁকফোকরগুলো দিয়ে সিংহভাগ অর্পিত সম্পত্তি যে বৈধ দাবিদারদের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে, সে আশঙ্কা থেকেই যায়। হিন্দু যৌথ পরিবারের এক সহ-অংশীদারের সম্পত্তির ওপর অন্য সহ-অংশীদারের দাবি প্রথাগত আইনে স্বীকৃত হলেও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে মালিকের সংজ্ঞা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সহ-অংশীদারদের বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে তাদের এতোদিনের দাবির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আইনের মাধ্যমে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালের বর্তমান আইনে এই ত্রুটিগুলোর দিকে নজর রাখা হয়েছিল বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

২০০১ সালের আইনটিতে পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটিও পরিলক্ষিত হয়। যেমন: আইন বলবৎ হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে সরকার প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির জেলাওয়ারি তালিকা তৈরি করবে, সরকারি গেজেট প্রকাশ করবে এবং ধারা ১০ অনুযায়ী তালিকা প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য বৈধ দাবিদারদের আবেদন করতে হবে; নতুবা ২৬(১) (খ) ধারা অনুযায়ী, এর পরে আর ওই সম্পত্তিতে কোনো স্বত্ব, স্বার্থ বা অধিকার দাবি করা যাবে না। কিন্তু ওই চূড়ান্ত তালিকায় কোনো ত্রুটি বা অনিয়ম থাকলে এবং তার মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা সংশোধনের কোনো বিধান আইনে রাখা হয়নি, যার ফলে আইন প্রয়োগকালে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হতে পারে। (হোসেইন, ২০০১) ২০১১ সালের আইনে এই ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে সংশোধনীর মাধ্যমে ৩০০ দিনে বর্ধিত করা হয়। ইতিমধ্যে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে (বিডিনিউজ২৪.কম, ২৮ নভেম্বর ২০১১)।

এবারে ২০১১ সালের সংশোধিত আইনটি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। আইনটির অধীনে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় দুটি তফসিল প্রকাশিত হয়েছে। ‘ক’ তফসিলে সরকারের দখলে থাকা সম্পত্তির তালিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং ‘খ’ তফসিলে সরকারি তালিকাতে থাকা যেসব সম্পত্তি সরকারের দখলে নেই, ব্যক্তির দখলে আছে, তার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। ‘ক’ তালিকার সম্পত্তি ফেরত পেতে হলে জেলা জজের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা যাবে এবং ‘খ’ তালিকার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বা ট্রাইব্যুনালের কাছে গেজেট বিজ্ঞপ্তির ৩০০ দিনের মধ্যে উক্ত সম্পত্তির অবমুক্তির জন্য আবেদন করতে হবে। এবার মালিক এবং সম্পত্তির তালিকা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। সহ-অংশীদারদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এমনকি ‘জনস্বার্থে’ বলতে কোন সম্পত্তি বোঝানো হয়েছে তাও পরিষ্কার করা হয়েছে। ‘জনহিতকর’ সম্পত্তির ক্ষেত্রে, সম্পত্তিটি দেবোত্তর সম্পত্তি, শ্মশান বা দাতব্য প্রতিষ্ঠান হলে এবং এর কোনো মোহন্ত বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার যে কোনো নাগরিককে গেজেট প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে দরখাস্ত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। সেই ধরনের কোনো নাগরিক উৎসাহিত না হলে জেলা প্রশাসক একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করে তাদের বরাবরে উক্ত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করবেন।

আশার কথা যে, অতীতের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নতুন আঙ্গিকে আইনটিকে সাজানো হয়েছে। তালিকাভুক্ত অর্পিত সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত বিতর্কের ব্যাপারে সরকার এবং আইন বিভাগকেও মনে হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে আন্তরিক। একই সঙ্গে দেশের সুশীল সমাজও বিষয়টির অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছেন। ভুক্তভোগীদের জন্য এখনই সময় মালিকানার দাবি সঠিক ফোরামে তুলে ধরার। মনে রাখতে হবে, এ আইনের সুফল যাতে বঞ্চিতদের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবার।

তথ্য সূত্র
১। পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ দ্য ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট ইন রুরাল বাংলাদেশ; আবুল বারকাত, সাফিক উজ জামান, আজিজুর রাহমান, অভিজিত পোদ্দার, ১৯৯৭, এএলআরডি, ঢাকা।
২। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, তানিম হোসেইন শাওন, বুলেটিন, জুন ২০০১, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ঢাকা।
৩। ভূমিবার্তা, জুলাই ২০১২, এএলআরডি, ঢাকা।
৪। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের সুফল পাবেন কীভাবে? ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ, আইন এবং মানবাধিকারকর্মীদের জ্ঞাতব্য, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন জাতীয় সমন্বয় সেল, সেপ্টেম্বর ২০১২, এএলআরডি, ঢাকা।
৫। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিল সংসদে পাস, বিডি নিউজ ২৪ ডট কম, ২৮ নভেম্বর ২০১১।
৬। http://bdlaws.minlaw.gov.bd





রামুর ঘটনায় হাইকোর্টের
সুয়োমোটু রুল জারি

- মাবরুক মোহাম্মদ



রামুর বৌদ্ধপল্লী সাম্প্রদায়িক হামলায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে কক্সবাজারের রামু থানায় পুলিশ বাদী হয়ে ঘটনাটিতে ইন্ধন এবং ইসলামকে অবমাননার অভিযোগে উত্তম কুমারের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারায় একটি মামলা দায়ের করে। সেদিনই নিরাপত্তা হেফাজতের নামে উত্তম কুমারের মা মাধু বড়ুয়া এবং পিসী আদি বড়ুয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তী সময়ে তাদের দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়। উত্তম কুমারের মা এবং পিসী সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কয়েকবার জামিনের আবেদন করেন। কিন্তু কোনো আদেশ না দিয়ে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনগুলো মামলার রেকর্ড হিসেবে নথিবদ্ধ করে রেখে দেন। এই অবস্থায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র-এর একটি প্রতিনিধি দল মাধু বড়ুয়া এবং আদি বড়ুয়াকে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য গত ১৬ অক্টোবর ২০১২ তারিখে রামুতে যায়। পরদিন অর্থাৎ ১৭ অক্টোবর ২০১২ তারিখে স্থানীয় আইনজীবীদের সাথে আসক-এর আইনজীবীরা মাধু বড়ুয়া ও আদি বড়ুয়ার জামিনের শুনানির জন্য আদালতে উপস্থিত হন। কিন্তু ঐ দিন আদালত মামলার শুনানি থেকে বিরত থাকে।

একই দিন উত্তম কুমারের মা ও পিসীকে গ্রেফতারের বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ আমলে নিয়ে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল জারি করেন। রুলে আদালত মাধু বড়ুয়া এবং আদি বড়ুয়ার আটক ও গ্রেফতার কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তার কারণ আগামী ১২ ঘণ্টার মধ্যে জানানোর জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। এই মামলায় ইন্টারভেনর হওয়ার জন্য আইন ও সালিশ কেন্দ্র আদালতে আবেদন করে।

১৮ অক্টোবর ২০১২ তারিখে ইস্যুকৃত সুয়োমোটু রুলের নিয়মিত শুনানির দিন ধার্য ছিল। এদিন আসক-এর আইনজীবীরা মাধু বড়ুয়া এবং আদি বড়ুয়ার জামিনের আবেদন নাকচ করে তাদের জেলহাজতে প্রেরণের বিষয়টি আদালতে তুলে ধরেন। তারা এই বিষয়ে আদালতের একটি নির্দেশনার জন্যও আবেদন জানায়। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মাধু বড়ুয়া ও আদি বড়ুয়ার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা নেই। এই অবস্থায় আদালত তাদের অবিলম্বে জেল থেকে মুক্তির আদেশ দেন। আদেশে আদালত আরও বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া মাধু বড়ুয়া ও আদি বড়ুয়াকে জেলহাজতে প্রেরণ সম্পূর্ণ অবৈধ ও অসাংবিধানিক। আদালত মাধু বড়ুয়া ও আদি বড়ুয়াকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস অথবা আইন ও সালিশ কেন্দ্র-এর আশ্রয়কেন্দ্র অথবা তাদের পছন্দমতো স্থানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করার আদেশ প্রদান করেন। আদালতের এই আদেশের পর সেদিন রাতেই মধু ও আদি বড়ুয়াকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পর আসকের আইনজীবীরা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা মাধু বড়ুয়া ও আদি বড়ুয়ার আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)- এর আশ্রয় হোমে থাকার বিষয়ে আলোচনা করেন। মাধু ও আদি বড়ুয়া তাদের নিজ বাড়িতেই থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর পুলিশ পাহারায় তাদের নিজ বাড়িতে প্রেরণ করা হয় এবং সেখানেই তাদের পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়। পরদিন আসক প্রতিনিধি দল মধু ও আদি বড়ুয়ার অবস্থা এবং পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের বাড়িতে যান।



হিন্দু আইন ও সংস্কারের এক ধাপ

- নীনা গোস্বামী



প্রাচীন হিন্দু আইনে বিধিবদ্ধ আইনের সংখ্যা খুবই কম। প্রথার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা হিন্দু আইনে যা কিছু সংস্কার সেই ঔপনিবেশিক আমলেই হয়। তাই তো সাহসী সব পদক্ষেপ, যেমন- সতীদাহ প্রথা রদ এবং হিন্দু বিধবা আইনের প্রচলন এই সময়ই হয়।

যেসব বিধিবদ্ধ আইনের ওপর ভিত্তি করে হিন্দু আইন বা হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইনের একটি কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act,1946, The Hindu Women’s Rights to Property Act, 1937, The Hindu Gains of Learning Act, 1930, The Hindu Disposition of Property Act. 1916 (Act. No. xv of 1961),The Hindu Inheritance (Removal of Disabilities) Act (Act. No. xii of 1928), The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act, 1929, The Hindu Marriage Disabilities Removal Act, 1946, The Hindu Women’s Rights to Property (Extension to Agricultural Land) Act, 1943 (Assam Act No. xiii of 1943), The Hindu Widow’s Re-marriage Act, 1856 (Act No. xv of 1856), The Hindu Religious Welfare Trust Ordinance, 1983 (Ordinance No. l xviii of 1983 প্রভৃতি।
উপরোক্ত আইনগুলো দেখলেই বোঝা যায় পারিবারিক আইন ‘বিবাহ, ভরণপোষণ, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, বিবাহ বিচ্ছেদ’ বিষয়ক (শুধু The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act,1946)বাদে কোনো আইনই অদ্যাবধি তৈরি হয়নি। ১৯৪৬ সালের পরে হিন্দু আইনের কোনো সংস্কার দেখা যায় না। এই সত্তর বছরে কোনো সরকারই এই বিশেষ দিকটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি। গত আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই হিন্দু নারীদের মধ্যে থেকে বেশ কিছু দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। ১৯৮৫-৮৬ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের দাবি উত্থাপিত হয়। সব ধর্মের সকল নারীর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টিকারী সকল আইন বাতিল করে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়নের এই দাবি উত্থাপন করেন নারী নেতৃবৃন্দ এবং তাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সকল ধর্মের কট্টরপন্থিরা এর বিরোধিতা করেন। সমস্যা ছিল অন্য জায়গাতেও। মুসলিম পারিবারিক আইনে নারীদের কিছু অধিকার থাকলেও অন্য ধর্মে, বিশেষ করে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারীদের অধিকারের জায়গাটি ছিল প্রায় শূন্য। এক কথায় বলতে গেলে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের জন্য যে ধরনের ’সাম্য’ অবস্থার এবং সহ-অবস্থান প্রয়োজন, তা ছিল না। ১৯৮৯-৯০ সালে আবারও বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর পাশাপাশি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় হিন্দুধর্মের ছোট ছোট সংস্কারের দাবি উত্থাপন করার। এই সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা হয়েছে। কট্টরপন্থিরা বলেছেন, হিন্দু ধর্মের সংস্কার সংসদের আইন দ্বারা কখনো হয়নি। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলেন উপরোল্লিখিত আইনগুলোর কথা, যা এখনো চলমান। তবু আন্দোলন থেমে থাকেনি। এত সব আন্দোলনের পরেও দেখা যায়, যখন যে সরকারই এসেছে তারা আইনে ‘ইউনিফর্ম’ অর্থাৎ সকল নাগরিকের জন্য একই আইন এই তথ্য আমলে নেয়নি। কারণ ব্যক্তিগত আইনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সবসময়। পারিবারিক আইনের ব্যবহারে ব্যক্তিগত আইনের প্রয়োগ থাকায় হিন্দু আইন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের অবস্থানেই রয়ে গেছে। মানুষের প্রয়োজনেই যে আইন এ কথাটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। আজ মনে হয়, আইনের প্রয়োজনেই মানুষ এ কথাটি বুঝি একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

নারী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ২০০৯ সালে গঠিত হয় হিন্দু আইন প্রণয়নে নাগরিক জোট। এই জোটের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ হিন্দু বিয়ে আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করে আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। এ আইনের মধ্যে ছিল বিয়ে রেজিস্ট্রেশন, আদালতের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ, বহুবিয়ে রোধ ইত্যাদি। কিন্তু নাগরিক জোটের প্রেরিত খসড়া আইন থেকে সরকার শুধু বিয়ে রেজিস্ট্রেশন আইন পাস করে। তবে অনেক না পাওয়ার মধ্যে বর্তমান সরকারের নেয়া উল্লেখযোগ্য আইনি সংস্কার হলো- হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২ এবং Registration (Amendment) ২০১২ জাতীয় সংসদে পাস করা। আমি প্রথমেই হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২-এর সুবিধাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রথমত, সংবিধিবদ্ধ আইনের অনুপস্থিতির ঝুড়িতে এটি পার্লামেন্ট থেকে পাসকৃত আইন, যার প্রেক্ষিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চাইলে অন্তত তাদের বিয়ে নিবন্ধন করার পথটি সুগম হলো। দ্বিতীয়ত, এই আইনটি সংখ্যালঘু হিন্দু সমপ্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারে ছোট হলেও একটি আইনের যোগ, যার দ্বারা অন্তত এটি বলা যায় ‘হিন্দু ব্যক্তিগত আইন সংস্কারযোগ্য নয়’- কথাটি ঠিক না। এই আইনটির বেশ কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন: এই আইনটি হিন্দু সমপ্রদায়ের সকল নাগরিক মানতে বাধ্য- এমন বাধ্যবাধকতা না থাকায় শুধু এক শ্রেণির মানুষ এই আইনটির সুবিধা ভোগ করবে। সকল শ্রেণির নাগরিক সুবিধা পাবে না। উদাহরণ: যারা বিদেশে যেতে চাইবে তারাই শুধু বিয়ে রেজিস্ট্রি বেশি করবে। অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। কারণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিয়ে অস্বীকারের যে প্রবণতার জন্য নারীরা দিনের পর দিন প্রতারিত হয় এই আইনের প্রয়োগে বাধ্যবাধকতার কজটি বাদ দেয়ায় আইনটি নারীদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু আইন অনুসরণ করেন। তাদের ব্যক্তিগত আইন বলে কিছু নেই। এই আইনটি শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু হিন্দু আইন অনুসারীরা এই আইনের আওতায় বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন এমন কথাটি যদি যুক্ত করা হতো, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যারা হিন্দু আইন অনুসারী তারাও এই আইনের সুবিধা ভোগ করতে পারতেন। সবচেয়ে বড় অসুবিধা এই যে, আইনটির কার্যকরের তারিখ নির্ধারণ করে এখনও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। বিধি প্রণয়নও হয়নি। বিধি প্রণয়ন হওয়ার পরই কেবল সরকার হিন্দু বিয়ে রেজিস্টার নিয়োগ দিতে পারবেন। আর তখনই আইনটি প্রায়োগিক দিক থেকে কার্যকারিতা পাবে। প্রসঙ্গক্রমে শতাধিক বছর আগে রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৯০৮-এর যে সংশোধনী আনা হয়, যা এখানে তুলে ধরা হলো- '(bb) registration fee payable for registration of a declaration of gift of any immovable property made under the Hindu, Christian and Buddhist Personal Law, if such gift is permitted by their Personal Law, shall be one hundred taka irrespective of the value of the property, provided such gift is made between spouses, parents and children, grand parents and grand children, full brothers, full sisters and, full brothers and full sisters'.
এই আইনটিতে সংশোধনী আনার ফলে সুবিধা ভোগ করবেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল ধর্মাবলম্বীই। এর উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কোনো মা-বাবা তার জীবিত অবস্থায় বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যদি চান তাদের কন্যাসন্তানকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে যেতে (যেহেতু মৃত্যুর পর ছেলে থাকলে কন্যাসন্তানরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়), তাহলে তারা মাত্র ১০০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে নির্ধারিত সম্পত্তি কন্যার অনুকূলে দান বা গিফট করতে পারবেন। এই আইনটির ক্ষেত্রেও একই অসুবিধা আছে। এখনও এর প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। আমরা আশা করবো উল্লেখিত দুটি আইনেরই কার্যকারিতা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২ অনেক না পাওয়ার মধ্যেও আলো বয়ে আনে। এটির ব্যাপক প্রচার আবশ্যক। এ ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়। হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইনের কারণে ভুক্তভোগী হিন্দু স্বামী-স্ত্রীদের জন্য বিয়ে বিচ্ছেদ আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act,1946 কারণে ভুক্তভোগী স্বামী-স্ত্রী একে অপরের থেকে আলাদা থাকতে পারেন। কিন্তু তা বিবাহের পরিসমাপ্তি ঘটায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই সারাজীবন আইন না থাকার কারণে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে সরকারের উচিত হবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হলেও শর্তসাপেক্ষে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া।

0 comments:

Post a Comment