Hot!

শিশু দত্তক নিতে নতুন বিধি হচ্ছে

ফরিদ আহমেদ

  • ২৬ জানুয়ারি ২০১৪
শেয়ার করুন
মিডিয়া প্লেয়ার বাদ দিন
আজিমপুর শিশু নিবাসে বসবাস করছে এমন অনেক পরিত্যক্ত শিশু
Image captionআজিমপুর শিশু নিবাসে বসবাস করছে এমন অনেক পরিত্যক্ত শিশু।
বাংলাদেশে কোন শিশুকে অ্যাডপ্শন বা দত্তক নেয়ার বিষয়ে কোন আইনি কাঠামো না থাকলেও দত্তক বা সন্তান পালক নেয়ার বিষয়টি থেমে নেই এবং দীর্ঘকাল ধরেই নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে তা অব্যাহত রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, হালে নানা কারণে নি:সন্তান দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে এবং তাদের অনেকেই এখন শিশু দত্তক নিতে চাইছেন।
কোন দম্পতি যদি পরিত্যক্ত শিশুর ‘অভিভাবকত্ব’ নিতে চান, তারা পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আবেদন করতে পারেন।
তবে সরকারী বা বেসরকারি কোন সেইফ হোম কিংবা হাসপাতাল যেখান থেকেই নেয়া হোকনা কেন, অভিভাবক হবার এই প্রক্রিয়াটিকে অনেকেই কিন্তু জটিল বলছেন এবং অনেকেই এক পর্যায়ে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক জায়েদা শারমিন বলছিলেন, সরকারী শিশু নিবাসের একটি শিশুকে তার দত্ত নেয়ার ইচ্ছা থাকলেও আইনি জটিলতার কারণে তিনি শিশুটিকে পালন করতে নিতে পারেননি।
“আমার নিজের বাচ্চা না থাকায় ঐ বাচ্চাটিকে দত্তক নিতে চেয়েছিলাম। এখন প্রায়ই আমি শিশু নিবাসে গিয়ে ওকে দেখে আসি। ওদের সাথে সময় কাটাতে আমার বেশ ভালই লাগে। আইন সহজ হলে আমি হয়তো ওকে নিজের সন্তানের মতো বড় করতে পারতাম,” বলছিলেন জায়েদা শারমিন।
আইনি জটিলতার কারণে অনেকেই এমন শিশুদের পালন করতে নিতে উৎসাহ কারিয়ে ফেলেন।
Image captionআইনি জটিলতার কারণে অনেকেই এমন শিশুদের পালন করতে নিতে উৎসাহ কারিয়ে ফেলেন।
কিন্তু অভিভাবকত্ব আর দত্তক এক বিষয় নয়। মূলত শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনে কোন বিধান না থাকায় ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইনের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি একটি শিশুর দায়ভার নিতে পারেন একজন অভিভাবক হিসেবে।
তবে বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশের পর শুধুমাত্র হিন্দু আইনে হিন্দু পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আইনসিদ্ধ। আর বাংলাদেশের খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীরাও শুধু অভিভাবকত্ব নিতে পারেন।
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে জটিল প্রক্রিয়ার কথা ভুক্তভোগীরা বলছেন তা মানতে রাজী নন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির কর্মকর্তা এডভোকেট সালমা আলী।
তিনি বলেন, “বাচ্চার নিরাপত্তার স্বার্থে অবশ্যই খুব ভাল করে যাচাই করেই অভিভাবকত্ব দেয়ার বিষয়টি করা উচিৎ। না হলে ঝুঁকি থাকে যে বাচ্চা ভুল মানুষের হাতে পড়ে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।‌”
দত্তক নেয়ার বিষয়টি কৃষি-প্রধান সমাজে সবসময়ই প্রচলিত ছিল। ভারতবর্ষে পৌরাণিক গ্রন্থ মনুসংহিতায় বলা হয়েছে: পুত্রার্থে ক্রীয়:তে ভার্যা, অর্থাৎ পুত্রসন্তান উৎপাদনের জন্যেই স্ত্রী।
কিন্তু সন্তান না হলে স্বামীর মর্যাদা খাটো হতো আর স্ত্রীকে বলা হতো অপয়া। তাই প্রাচীনকালে হিন্দু সমাজে এক পর্যায়ে প্রচলন হয় অন্যের ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তানকে গ্রহণ বা দত্তক প্রথার।
একটি সময় এর মূল কারণটি ছিল অনেকাংশে অর্থনৈতিক এবং একই সাথে ধর্মীয়। কিন্তু বর্তমান সময়েও কি তাই আছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, আধুনিক সমাজে সন্তান দত্তক নেয়ার কারণ মনস্তাত্ত্বিক ও আবেগের। ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছরের দিকে গিয়ে সন্তান ধারণের সম্ভাবনা না থাকলে নি:সঙ্গতা কাটাতে সন্তান দত্তক নেয়ার কথা ভাবছে মানুষ।
মি. আহমেদ আরও বলছিলেন, “শিল্প-ভিত্তিক সমাজে যেসব সমস্যা তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে অনেক নারী গর্ভধারণ করতে পারছে না। দীর্ঘদিন ধরে জন্মবিরতীকরণ বড়ির প্রভাব, রাসায়নিক মিশ্রিত খাবার, জরায়ুর ক্যান্সারসহ বিভিন্ন কারণে বন্ধ্যত্ব বাড়ছে। ফলে এ কারণেও বাংলাদেশে দত্তক নেয়ার বিষয়টি দিন দিন বাড়ছে।‌”
Image captionনানা কারণে বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে বন্ধ্যত্ব বাড়ছে।
একই সাথে নানা সামাজিক ও আইনি জটিলতাও বাড়ছে এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আইনি জটিলতাটি মূলত উত্তরাধিকার প্রশ্নে।
আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিভাবকত্ব পেলেও একটি শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে কিন্তু পালক নেয়া বাবা-মায়ের কোন সম্পত্তি পায়না। কেননা বাংলাদেশে ইসলামী আইনের অনুসরণ করা হয় এবং মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে আদালত শুধু সন্তানের অভিভাবক হবার অনুমতি দেয়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের একজন পরিচালক ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ আল-মারুফ বলছিলেন, ইসলামী আইনের আলোকে পালিত শিশু পালক পিতামাতার সম্পদের উত্তরাধিকারী হবেনা। সে ঐ বাবা-মায়ের নামও ব্যবহার করতে পারবেনা। তবে তারা পালক সন্তানকে সম্পত্তি দান করে দিতে পারেন বা ওয়াসিয়ত করতে পারেন।
দান কিংবা ওয়াসিয়ত করা গেলেও এই উত্তরাধিকারের প্রশ্নেই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে অনেক পরিবারে। একদিকে নি:সন্তান দম্পতিরা চাইলেও পালিত সন্তানকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার করতে পারেননা। অন্যদিকে সম্পত্তির অধিকার থেকে পালিত সন্তানও বঞ্চিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক শাহনাজ হুদা এ বিষয়ে গবেষণা করে দেখেছেন মূলত সম্পত্তির অধিকার প্রশ্নেই সমস্যার জটিলতা শুরু হয়। তিনি বলেন, “পালক নেয়া বাবা মায়ের মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়রা এসে যদি সম্পত্তি থেকে ঐ সন্তানকে বঞ্চিত করে, তাহলে কিন্তু আইনত তার কিছুই করার থাকেনা। এটা একটি বিরাট সমস্যা।‌”
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের গর্ভে জন্ম হওয়া শিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাদের দত্তক দিতে ১৯৭২ সালে একটি বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে শিশু পাচার বা ধর্মান্তরিত হবার ঘটনার প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালে সরকার আইনটি বাতিল করে।
ফলে দত্তক যেমন নেয়া যায়না, তেমনি কোন বিদেশী নাগরিকও বাংলাদেশের কোন শিশুর অভিভাবক হতে পারেনা। তাছাড়া, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের প্রথম দিকের স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও শিশু দত্তক নেয়ার ধারাটি অনুস্বাক্ষর করেনি।
Image captionবিশ্বের বিভিন্ন দেশে দত্তক সন্তান প্রাকৃতিক সন্তানের মতো উত্তরাধিকার পাবার যোগ্য। তবে বাংলাদেশে ধর্ম ভেদে ভিন্ন নিয়ম রয়েছে।
তবে ১৯৮২ সালে দত্তক নেয়ার আইন বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত বহু পরিত্যক্ত শিশুকে এই আইনের আওতায় দত্তক দেয়া হয়েছিল। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই দত্তক মানেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাকৃতিক সন্তানের মতো উত্তরাধিকার পাবার যোগ্য হয়।
বাংলাদেশে গতবছর আইন কমিশন থেকে পৃথক একটি দত্তক আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এখন সরকারের দিক থেকে এ নিয়ে একটি বিধি প্রণয়নের কথাও ভাবা হচ্ছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাসিমা বেগম বলছিলেন বর্তমানে শিশু আইনের আওতায় বিকল্প যত্ন বা পরিচর্যার নীতির আলোকে তারা এই বিধি করতে যাচ্ছেন।
“আমরা মনে করি, শিশু নিবাসের চাইতে একটি পরিবারে বাবা মায়ের আদরে একটি শিশু বড় হলে তা ভাল হবে। তাই আমরা বিষয়গুলো সহজ করার কথা ভাবছি ,” বলছিলেন নামিমা বেগম।
তিনি আরও বলেন, বিধিটি তৈরি হবার পর সরকারী তত্বাবধানে থাকা শিশুদের যেসব পরিবার গ্রহণ করবে, সেখানে তাদের ১৮ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত সময় সময় লালন পালনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবে সরকার।
এরপর তারা আইনত নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব নিতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।

1 comments: