Hot!

ভরণপোষণ-সংক্রান্ত হিন্দু আইন



হিন্দু আইনে ভরণপোষণ : ভারতে প্রযোজ্য ১৯৫৬ সালের হিন্দু দত্তক গ্রহণ ও ভরণপোষণ আইন যদিও বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়, তবে এখান থেকে হিন্দু আইনে ভরণপোষণের কী সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা দেখে নেয়া যেতে পারে। আইনটির ৩(খ) ধারায় ভরণপোষণের সংজ্ঞায় ভরণপোষণ বলতে সর্বাবস্থায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার বিধান করা এবং অবিবাহিতা কন্যাদের ক্ষেত্রে তাদের বিয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করাকে বোঝায়। হিন্দু ভরণপোষণ আইন অনুযায়ী, একজন হিন্দু ব্যক্তি তার নাবালক পুত্র, অবিবাহিতা কন্যা, স্ত্রী ও বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকে।
ভরণপোষণের প্রকারভেদ : একজন হিন্দু ব্যক্তির ভরণপোষণের দায়িত্ব দুই ধরনের। প্রথমটি নিরঙ্কুশ দায়িত্ব। একজন হিন্দু তার ধার্মিক স্ত্রী, নাবালক পুত্র, অবিবাহিতা কন্যা, বৃদ্ধ বাবা-মা ও অবৈধ সন্তানের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত সীমিত দায়িত্ব। উলি্লখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া ভরণপোষণের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে পৈতৃক সম্পত্তি হস্তান্তর করা যায়।



ভরণপোষণের ব্যক্তিগত দায়িত্ব : একজন হিন্দুর সম্পত্তি থাকুক বা না থাকুক, সে তার স্ত্রী, নাবালক পুত্র, অবিবাহিতা কন্যা, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণ প্রদানে আইনগতভাবে বাধ্য। এদের ভরণপোষণের দায়িত্ব ব্যক্তিগত প্রকৃতির। উলি্লখিত সম্পর্কগুলোর মধ্যে বিশেষ আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার কারণেই এ দায়িত্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে। সাবিত্রিবাই বনাম লক্ষ্মীবাই মামলায় ১৮৭৮ সালে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বোম্বে হাইকোর্ট।
কর্তার দায়িত্ব : সহ-অংশীদারী সম্পত্তির মালিক হিসেবে মিতাক্ষরা যৌথ পরিবারের কর্তা পরিবারের সব পুরুষ সদস্য এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণ দানে আইনত বাধ্য। কোনো একজন পুরুষ সদস্যের মৃত্যুতে কর্তা তার বিধবা স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণ দানে আইনত বাধ্য থাকেন। ভগবান সিং বনাম কেওয়াল কাউর (১৯২৭) মামলায় এ সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। কর্তার ভরণপোষণের দায়িত্ব-সংক্রান্ত একই নীতি দায়ভাগ আইনেও প্রযোজ্য হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় মূলত দায়ভাগ নীতি অনুসরণ করে থাকে।
উত্তরাধিকারীদের দায়িত্ব : উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিকানার ভিত্তিতে একজন উত্তরাধিকারী তার ওপর অর্পিত সম্পত্তি থেকে সেসব ব্যক্তির ভরণপোষণ প্রদান করতে বাধ্য থাকেন, যাদের ভরণপোষণ দানে মৃত স্বত্বাধিকারী আইনত ও নৈতিকভাবে বাধ্য ছিলেন। কেননা এ ক্ষেত্রে ওইসব ব্যক্তিকে ভরণপোষণের শর্তে ওই সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত হয়েছে। ক্ষেত্রমণি বনাম কাশিনাথ, কামিনী বনাম চন্দ্র মামলাগুলোয় এ সিদ্ধান্ত দেন আদালত।
সরকারের দায়িত্ব : যদি সম্পত্তি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয় তবে ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকারের ওপর অর্পিত হয়। গোলাব কুনওয়ার বনাম কন্ট্রোলার অব বেনারস (১৮৪৭) মামলায় এ সিদ্ধান্ত আসে।
ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী ব্যক্তি : হিন্দু আইনের বিধান অনুসারে পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, পৌত্র-পৌত্রী, যৌথ পরিবারের মহিলা সদস্য, অক্ষম উত্তরাধিকারী, অবৈধ পুত্র, অবৈধ কন্যা, উপপত্নী ও অবরুদ্ধ স্ত্রী ভরণপোষণ পেয়ে থাকেন।
পুত্রের অধিকার : ব্যক্তিগত দায়িত্ব অনুসারে একজন পিতা তার নাবালক পুত্রদের ভরণপোষণ দানে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে পিতা তার পৃথক ও স্ব-উপার্জিত সম্পত্তি থেকেও নাবালক পুত্রদের ভরণপোষণে বাধ্য থাকেন। দায়ভাগ আইন অনুসারে পিতা তার সাবালক পুত্রদের ভরণপোষণ দানে বাধ্য নন। মিতাক্ষরা আইন অনুযায়ী একজন সাবালক পুত্র যৌথ পরিবারের সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। কেননা মিতাক্ষরা আইন অনুযায়ী একজন পুত্র জন্মসূত্রে যৌথ পরিবারের সম্পত্তিতে অর্পিত স্বার্থ অর্জন করে। শতরাজ কুয়ারি বনাম দেওরাজ কুয়ারি (১৮৮৮) মামলায় এ রায়ে আসে।
কন্যার অধিকার : একজন পিতা তার ব্যক্তিগত দায়িত্ব অনুসারে অবিবাহিতা কন্যাদের ভরণপোষণ দানে বাধ্য। পিতার মৃত্যুর ক্ষেত্রে অবিবাহিতা কন্যারা তাদের পিতার সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হয়। তুলশা বনাম গোপাল রায় (১৮৮৪) এবং বাই মঙ্গল বনাম বাই রাখমিনি (১৮৯৯) মামলাগুলোয় এ ব্যাপারে বিধান বলা হয়। স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভে সক্ষম বিবাহিতা কন্যা বা স্বামীর মৃত্যুর পর বিবাহিতা কন্যার ভরণপোষণ দানে একজন পিতা নৈতিকভাবে বাধ্য; তবে এ ক্ষেত্রে তিনি আইনগতভাবে বাধ্য নন। মতিলাল বনাম ব্রজবাসী (১৯৬০) ১২ ডিএলআর মামলায় এ সিদ্ধান্ত দেন আদালত।
এ ধরনের মেয়েরা তাদের পিতার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তি থেকে তার উত্তরাধিকারী কর্তৃক আইনগতভাবে ভরণপোষণ লাভের অধিকারী কি না, সে বিষয়টি এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি। বোম্বে হাইকোর্ট এ ক্ষেত্রে একটি মামলায় সিদ্ধান্ত দেন যে কন্যা এ ধরনের কোনো অধিকার অর্জন করে না। বাই মঙ্গল বনাম বাই রাখমিনি (১৮৯৯) এবং কান্তমণি বনাম শ্যামচন্দ (১৯৭৩) মামলায় আদালত এমন সিদ্ধান্ত দেন।
স্বামী থেকে পৃথক স্ত্রীর ভরণপোষণের অধিকার : বাংলাদেশের হিন্দু আইনে বিবাহবিচ্ছেদ স্বীকৃত নয়। এ কারণে হিন্দু নারীরা তাদের বিয়ে বাতিল করতে পারেন না। তবে হিন্দু বিবাহিত নারীর পৃথক বসবাস এবং ভরণপোষণের অধিকার আইন, ১৯৪৬ অনুসারে বাংলাদেশের হিন্দু বিবাহিত নারীরা কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে স্বামী থেকে পৃথক বসবাসের অনুমতি পেতে পারেন। এ জন্য তাদের আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তার স্বামী এমন কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, যার জন্য সেই নারী দায়ী নয়; অথবা তার সঙ্গে বসবাস করা নিরাপদ নয়; অথবা তার স্বামী বিনা সম্মতিতে তাকে পরিত্যাগ করেছেন; অথবা তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন; অথবা তার স্বামী হিন্দু থেকে অন্য ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন; অথবা তিনি দুশ্চরিত্রের নারীর সঙ্গে মেলামেশা করে থাকেন। এ ছাড়াও অন্য কোনো যৌক্তিক কারণে স্বামীর সঙ্গে বসবাস অসম্ভব হয়ে পড়লে আদালত হিন্দু নারীকে পৃথক থাকার অনুমতি দিতে পারেন। এ রকম অবস্থায় এ ধরনের নারীর ভরণপোষণের ভার তার স্বামীর ওপরই থাকবে। আইনের ৩ ধারা অনুসারে আদালত হিন্দু সেই নারীকে প্রদানের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঠিক করে দেবেন, যা তার স্বামীকে প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হবে। ভরণপোষণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারীরা সামাজিক মর্যাদা এবং পুরুষটির আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনায় নেয়া হবে।- See more at: http://www.jjdin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=06-8-2013&feature=yes&type=single&pub_no=563&cat_id=2&menu_id=76&news_type_id=1&news_id=79425#sthash.AzbuIIpx.dpuf

0 comments:

Post a Comment