Hot!

বাংলাদেশের হিন্দু দত্তক আইনে যুগোপযোগিতার অভাব

বাংলাদেশের হিন্দু দত্তক আইনে যুগোপযোগিতার অভাবসন্তান দত্তক গ্রহণের অধিকারের স্বীকৃতি মুসলিম ধর্মে স্বীকৃত না হলেও হিন্দু ধর্মে এর শাস্ত্রিক ও আইনি বৈধতা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রচলিত সনাতন হিন্দু আইনে দত্তক গ্রহণ ও প্রদানের ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার খানিকটা সীমিত। তবে ভারতে বিধিবদ্ধ আইনের মধ্য দিয়ে দত্তক আইনে নারীদের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন বাদল কুমার চন্দভারতের দত্তক আইনে হিন্দু নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা হয়েছেঅন্যের পুত্রকে নিজ পুত্র হিসেবে গ্রহণ করার প্রক্রিয়াকেই আইনের ভাষায় দত্তক বলা হয়। যখন কোনো ব্যক্তির পুত্রসন্তান থাকে না, তখন তিনি দত্তক গ্রহণ করতে পারেন। হিন্দুধর্মে দত্তক গ্রহণের অন্যতম উদ্দেশ্য ধর্মীয় অর্থাৎ পি-দানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সুবিধা অর্জন করা। অন্যভাবে বলা যায়, উত্তরাধিকারী অর্জনের মধ্য দিয়ে দত্তক গ্রহণকারীর নামকে চিরস্থায়ী করা দত্তক গ্রহণের উদ্দেশ্য। হিন্দু আইনের আওতায় দত্তক গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং বৈধতা স্বীকার করা হয়েছে। অবশ্য মুসলিম আইনে দত্তক গ্রহণ স্বীকৃত নয়। শাস্ত্রীয় হিন্দু আইনে পাঁচ প্রকারের দত্তক প্রচলিত থাকলেও আধুনিক হিন্দু আইনে দুই ধরনের দত্তক পুত্রকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে: দত্তকা ও কৃত্তিমা। 'দত্তকা' প্রকৃতির দত্তক গ্রহণই সাধারণভাবে সর্বত্র প্রচলিত আছে।
দত্তক গ্রহণ ও প্রদানের ক্ষেত্রে হিন্দু আইনে কিছু সাধারণ নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়। দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষের একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকে। হিন্দু সনাতন আইনে স্ত্রীর দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা স্বীকৃত নয়। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর কেবল স্বামীর মঙ্গলের উদ্দেশে তিনি দত্তক নিতে পারেন। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী কোনো সন্তান দত্তক গ্রহণ করতে পারেন না।

সন্তানকে দত্তক প্রদানের ক্ষেত্রেও ক্ষমতা কেবল পিতার হাতেই থাকে। দত্তক প্রদানকারীকে সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হয়। যাকে দত্তক হিসেবে নেয়া হবে তাকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে। বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্রকে দত্তক নেয়া যাবে না এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুকেও দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা সনাতন আইনে স্বীকৃত নয়। দত্তক গ্রহণের সময় 'দত্তহোম' নামের বিশেষ একটি অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। এই অনুষ্ঠানে পবিত্র অগি্নতে ঘি দেয়া হয়, যাকে 'অগি্ন-শুদ্ধি' অনুষ্ঠানও বলা হয়। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সব বর্ণের ক্ষেত্রে এ অনুষ্ঠান পালন বাধ্যতামূলক নয়। দত্তক নিজে যদি সাবালক হয়, সে ক্ষেত্রে তাকে দত্তকে দিতে হলে তার সম্মতি নেয়া বাঞ্ছনীয়।
দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। প্রথাগত আইন, নিয়ম ও কিছু আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করেই এখানে দত্তক গ্রহণ করা হয়। সে ক্ষেত্রে একজন হিন্দু পুরুষ সহজেই দত্তক নিতে পারে। অবিবাহিতা হিন্দু নারী কোনো দত্তক নিতে পারে না। বিবাহিতা হিন্দু নারী স্বামীর সম্মতি ছাড়া দত্তক নিতে পারে না। বাংলাদেশে প্রচলিত দায়াভাগা আইন অনুযায়ী একজন বিধবা স্বামীর কাছ থেকে কর্তৃত্ব লাভের মাধ্যমে তার পক্ষে দত্তক গ্রহণ করতে পারে। এ কর্তৃত্ব অর্জন প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত হতে পারে। স্ত্রীর দত্তক গ্রহণের ক্ষমতার ওপর স্বামী কোনো নিষেধাজ্ঞা দেননি, কেবল এ বিষয়টির ওপর ভিত্তি করে স্ত্রীর অব্যক্ত কর্তৃত্ব অর্জন হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায় না।
বাংলাদেশে দত্তকবিষয়ক কোনো বিধিবদ্ধ আইন নেই। তবে ভারতে অন্যান্য আইনের মতো দত্তক গ্রহণের আইনেও যুগোপযোগী পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৫৬ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর থেকে 'হিন্দু দত্তক এবং ভরণপোষণ আইন, ১৯৫৬' অনুযায়ী ভারতে দত্তক নেয়া হয়। এ আইন বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়। ১৯৫৬ সালের এ আইনের ফলে ভারতে প্রত্যেক পুরুষ দত্তক নিতে পারে যদি সে দত্তক গ্রহণের উপযুক্ত হয় বা দত্তক গ্রহণের সময় কোনো স্বাভাবিক বা দত্তক পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্র জীবিত না থাকে। দত্তক নিতে চাইলে দত্তক গ্রহণকারীকে অবশ্যই সুস্থ মস্তিষ্কের ও সাবালক হওয়া বাঞ্ছনীয়। সনাতন আইনে কেবল পুত্রসন্তানকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করার বিধান থাকলেও ভারতের এ আইনের বদৌলতে এখন মেয়েসন্তানকেও দত্তক গ্রহণ করা যায়। আইনের ৭ ধারায় এ অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। আগে একজন স্বামী তার স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই দত্তক নিতে পারত। কিন্তু ১৯৫৬ সালের আইনটি প্রণয়ন হওয়ার পর থেকে ভারতে এখন আর স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া দত্তক গ্রহণ সম্ভব নয়। তবে তিনটি ক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া স্বামী দত্তক গ্রহণ করতে পারবেন। প্রথমত স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে, দ্বিতীয়ত, স্ত্রী হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করলে, তৃতীয়ত, আদালত কর্তৃক স্ত্রীকে মস্তিষ্কবিকৃত হিসেবে ঘোষণা করা হলে। এ আইনের ১১ ধারা অনুসারে, কন্যাসন্তান দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে দত্তক গ্রহণকারী পিতার বয়স থেকে কন্যাসন্তানের বয়স ২১ বছরের কম হতে হবে। আগেকার আইনানুযায়ী একজন স্ত্রী তার স্বামীর জীবদ্দশায় তার স্পষ্ট সম্মতি ছাড়া দত্তক গ্রহণ করতে পারত না। ১৯৫৬ সালের আইনটি প্রণয়নের পর থেকে একজন হিন্দু নারী (যিনি সুস্থমস্তিষ্ক, সাবালিকা এবং অবিবাহিতা বা বিবাহিতা, যার স্বামী মারা গেছে বা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছে বা আদালত কর্তৃক মস্তিষ্ক বিকৃত ঘোষিত হয়েছে) অধিকার হিসেবে কোনো ছেলে বা মেয়েকে দত্তক নিতে পারেন। ছেলেসন্তান দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে দত্তক গ্রহণকারী মাতার বয়স থেকে ছেলে সন্তানের বয়স ২১ বছরের ছোট হতে হবে।
২০১২ সালের ৫ মে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা ভারতের কেন্দ্রীয় দত্তক সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে এক নিবন্ধে বলেছে, ২০১০ সালে ভারতে ৫৭০০ জন শিশুকে আইনগতভাবে দত্তক নেয়া হয়েছে; যা ২০০৯ সালের তুলনায় প্রায় ৩০০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতে আন্তঃদেশীয় দত্তক (ইন্টারকান্ট্রি অ্যাডোপশান) চালু আছে যেহেতু ভারত 'হেগ অ্যাডোপশান কনভেনশনে' স্বাক্ষর করেছে। এই কনভেনশনের মাধ্যমে শিশুদের অধিকারও সুরক্ষিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯০টি দেশ এ কনভেনশন অনুসমর্থন জানিয়েছে। কনভেনশনে স্বাক্ষর প্রদানকারী দেশগুলোয় ১৯৯৯-২০১১ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ২,৩৩,৯৩৪ জন শিশুকে আন্তঃদেশীয় দত্তক নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এখনো এ কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী একজন বিদেশিকে দত্তক নেয়া যায় না। যদিও বাংলাদেশ চিলড্রেন রাইটস কনভেনশনের (সিআরসি) সদস্য। কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২১ অনুযায়ী, আন্তঃদেশীয় দত্তক স্বীকৃত। এ অনুচ্ছেদটি বাংলাদেশ 'রিজার্ভ ক্লজ' হিসেবে নিয়েছে অর্থাৎ বাংলাদেশ এ বিধানটির ক্ষেত্রে নিজের সম্মতি স্থগিত রেখেছে।
বাংলাদেশে এখনো হিন্দু নারীদের দত্তক গ্রহণের অধিকার পুরোপুরিভাবে স্বীকৃতি পায়নি। সর্বোপরি হিন্দু প্রথা, শাস্ত্র ও ফ্যাক্টাম ভ্যালেটের নীতি অনুসরণ করে আমাদের দেশেও ভারতের আদলে 'হিন্দু দত্তক এবং ভরণপোষণ আইন, ১৯৫৬' এর মতো আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের অনিবার্য দাবি। সম্প্রদায়ের সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ ধরনের আইনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

- See more at: http://www.jjdin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=07-04-2013&feature=yes&type=single&pub_no=441&cat_id=3&menu_id=76&news_type_id=1&index=2#sthash.IQAj4whn.dpuf

0 comments:

Post a Comment