Hot!

আইনগুলো সব কেন রানাদের পক্ষে?


আইনগুলো সব কেন রানাদের পক্ষে?ডক্টর তুহিন মালিক


সমগ্র দেশ যখন সাভারের শত শত শ্রমিকের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি করছে, তখন রানার বিরুদ্ধে মামলা হলো দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারায়, যাতে বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানই আছে পাঁচ বছরের জেল। শত শত লাশের বিচারপ্রার্থী মানুষের সঙ্গে এ যেন পুলিশের এক নির্মম রসিকতা। জনদাবির ভয়াবহতা ও জনগণের চাপের মুখে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেটকেই। তিনি নির্দেশ দিলেন, ৩০৪(ক) ধারা নয়, বরং সংযোজন করতে হবে ৩০৪ ধারাকে। এই ধারায় যে কাজ দ্বারা মৃত্যু সংঘটন হয়, তার সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় সংশোধিত ধারাগুলোতে আরো সংযোজন করলেন মারাত্মক আঘাতজনিত দণ্ডবিধির ৩২৫, ৩২৬ ধারা এবং হত্যাচেষ্টাজনিত ৩০৭ ধারাটি। এখানেও আইনের প্রয়োগে সমস্যা দেখা দিল। কেননা ৩০৪ ধারা সংযোজিত হলে এই ধারাগুলো আর প্রযোজ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে এই ভুল ধারা সংযোজনের ফলে বিচারকালে তা আসামির পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই থেকে যায়। বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, রানা প্লাজা জায়গাটির প্রকৃত মালিকানা নাকি রানার বাবার নামে। তাহলে তো হতাশার মাত্রা আরো বেশি দৃশ্যমান। অন্যদিকে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করে ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের দায়ে ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় মামলা করা হলেও দুই প্রকৌশলীর কাউকেই মামলার কোনো এজাহারে রাখা হয়নি। তাই ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের মামলায় ত্রুটিপূর্ণ এজাহারটি শুধু মামলার অসম্পূর্ণতাই নয়, বরং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ ধারায় ভবিষ্যতে যে উচ্চ আদালতে কোয়াশ বা বাতিল হবে না তার নিশ্চিয়তা কোথায়? কারণ এই অপরাধে প্রধান দোষী হচ্ছেন নির্মাণ প্রকৌশলীরা। কিন্তু প্রিন্সিপাল অ্যাকিউজ্ড্ বা মূল আসামিদের বাদ দিয়ে সহযোগীর বিচারপ্রক্রিয়াটি আদালতে বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। যদিও মন্দের ভালো এই আইনে তাদের সাত বছরের জেল হতো, বর্তমানে সেটাও কিন্তু ঝুঁকিতে রয়ে গেল।
এখন আসা যাক ক্ষতিপূরণ আদায়ের আইনে। যদিও মানুষের জীবনের ক্ষতি কিছু দিয়েই পূরণ করা সম্ভব নয়, তবু আন্তর্জাতিক আইন থেকে শুরু করে বিশ্বের সব লিগ্যাল সিস্টেমে যতটুকু বেশি ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্তকে দেওয়া সম্ভব, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। উল্টোপথে হাঁটছি শুধু আমরা। কারণ এখানে মানুষের জীবনের মূল্যের চেয়ে হয়তো ডলারের মূল্যকেই আমরা বেশি প্রধান্য দিয়ে থাকি। নতুবা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর সনদকে আমরা মানতে বাধ্য বলে তাতে স্বাক্ষর করার পরও কেন আমাদের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিতে হয় যে তারা ক্ষমতায় গেলে আইএলও সনদ অনুযায়ী দেশের শ্রম আইন সংশোধন করবে? অথচ তারাই আবার ক্ষমতায় এসে আইএলও সনদ বাদ দিয়ে মালিকদের 'সনদ' মতে শ্রম আইন সংশোধন করে। দেশে যেখানে সরকারি কর্মচারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস নির্ধারিত, সেখানে কয় দিন আগের শ্রম আইনের সংশোধনীতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি রাখা হয়েছে মাত্র চার মাস। সেটাও আবার কেউ মানতে নারাজ। না হলে সাভারের ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দুটি শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঘটনা আমাদের করুণভাবে দেখতে হতো না। আসলে যেখানে চার মাস মাতৃত্বকালীন ছুটিতে ২৪ হাজার টাকা মজুরি পরিশোধ না করে বরং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করাটা আইনের বিধান থাকে, সেখানে যেকোনো ব্যবসায়ীর জন্যই জরিমানা আদায় করাটা অধিক লাভজনক। কেননা আইএলও সনদ নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে সভা-সেমিনার আর মহান মে দিবসে শ্রমিকদের শোভাযাত্রার মাঝে অনেক আগেই যে হারিয়ে গেছে আমাদের শ্রমিক অধিকারের সনদটি।
১৯৬৫ সালের শ্রম আইনে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ছিল ৩০ হাজার টাকা। তখন মজুরি ছিল ১২৫ টাকা। কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান ও দ্রব্যমূল্য আড়াই শ গুণ বাড়লেও ২০০৬ সালের শ্রম আইনে এই ক্ষতিপূরণ এক লাখ টাকা করা হয়, যা সম্প্রতি মন্ত্রিসভার নতুন শ্রম আইনের খসড়া অনুমোদনের সময় দুই লাখ টাকা করা হয়েছে; যদিও ১৮৫৫ সালের মারাত্মক দুর্ঘটনা আইনে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা হিসাব করে ক্ষতিগ্রস্তের গড় আয়ুর দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিধান রয়েছে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে এ রকম মারাত্মক অপরাধীর সম্পত্তি ক্রোক করে ট্রাস্ট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হতে পারে। এমনকি উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও একটি ফৌজদারি ক্ষতিপূরণ আইন প্রণয়ন করার দাবি উঠেছে। এ ক্ষেত্রে পৃথক একটি শ্রমিক নিরাপত্তা আইনের বিষয়ও মানুষের দাবিতে এসেছে। আসলে গার্মেন্ট মালিকদের অহরহ বলা কমপ্লায়েন্স শব্দটি মনে হয় বিদেশি ক্রেতাদের সন্তুষ্টির জন্যই বেশি প্রযোজ্য। আমাদের দেশের বিদ্যমান আইনগুলোরও যে কমপ্লায়েন্স মানা বাধ্যতামূলক, সেটা যেন তারা মানতেই নারাজ। ব্যবসা পেতে হলে সব রকম কমপ্লায়েন্সে রাজি মালিকরা, দেশের গরিব শ্রমিকদের জীবনের কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে কেন এতটা উদাসীন হবেন? কারণ আইন যেখানে তৈরি হয়, সেই আইনসভায় বা সংসদে সরাসরি ২৬ জন সদস্য এখন গার্মেন্ট মালিকদের প্রতিনিধি।
আর প্রচ্ছন্নভাবে গার্মেন্ট ব্যবসায় জড়িত আরো অন্তত অর্ধশতাধিক সংসদ সদস্য রয়েছেন, যা দেশের বর্তমান সর্ববৃহৎ বিরোধী দলের আসনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই যেখানে মালিকদের পাজেরো-প্রাডো গাড়ির জন্য বীমা করা আছে কোটি টাকার, গাড়ির প্রতিবছর প্রিমিয়াম দিতে হয় লাখ লাখ টাকার, সেখানে শ্রমিকের জন্য নেই কোনো বীমা সুবিধা। হ্যাঁ, আইনে আছে যে গোষ্ঠী বীমার আওতায় বাধ্যতামূলকভাবে ২০ জন শ্রমিকের বীমা সুবিধা রাখতে হবে। ব্যস, এতটুকুই। ২০ জনের জন্য রাখলেই যখন দায়িত্ব সম্পন্ন করা সম্ভব, তখন হাজারো শ্রমিকের জন্য কে অযথা খরচ করতে যাবে। তাও আবার বছরে মাত্র ১৭ হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে কাজ হলে ১০০ শ্রমিকের জন্য বছরে ৮৫ হাজার টাকা কেন দিতে যাবে। হাজার শ্রমিকের জন্য বছরে সাড়ে আট লাখ টাকা খরচ না করে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্যাশন শো করাটাই বিজিএমইএর কাছে বেশি প্রয়োজনীয়। তা ছাড়া শত শত মানুষ হত্যা করে গণপিটুনিতে মারা যাওয়ার চেয়ে কয়েক দিন জেলে থাকাটা যখন বেশি নিরাপদ, তখন এই আইন কার জন্য- এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় আমাদের এসেছে।
এ ধরনের গণহত্যার পর্যাপ্ত শাস্তির জন্য সংসদের এ অধিবেশনেই একটি 'গণহত্যা অপরাধ আইন' পাস করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এসব নরঘাতককে দ্রুত বিচারের আওতায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের আইন সংবিধানপরিপন্থী হবে না বলে আমাদের সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে নিশ্চয়তা দেওয়া আছে। সেই সঙ্গে আমাদের সংবিধানের ৪৭-ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই আইনে আগের যেকোনো সময়ের সংঘটিত অপরাধের বিচার রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্টে করা যাবে। এমনকি এসব ঘাতক সংবিধানের অধীনে কোনো প্রতিকারের জন্য উচ্চ আদালতে কোনো ধরনের আবেদন করার যোগ্যতা হারাবে বলে সংবিধানের ৪৭-ক(২) অনুচ্ছেদে নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। তাই শত শত মানুষের গণহত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদানে 'গণহত্যা অপরাধ আইন' সংসদে এই মুহূর্তে প্রণয়ন করাই হবে জনগণের একমাত্র দাবি। অন্য আরো বিকল্প হয়তো আছে, কিন্তু সেগুলো আগের মতোই অন্ধকারে হারিয়ে যাবে নিশ্চিতভাবে।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com

সূত্র:http://www.kalerkantho.com/print_edition/?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1231&cat_id=2&menu_id=20&news_type_id=1&index=1&archiev=yes&arch_date=03-05-2013#.VjsPwZP0o4k

0 comments:

Post a Comment